
কৌশিক বসু , দুর্গাপুর : খুব কঠিন রসায়ন ! অন্তত শিল্পাঞ্চলে যারা কয়লা , লোহা , বালির খোঁজ খবর রাখে , তাদের জন্য বেশ হেঁয়ালি ! রাজেশ ওরফে রাজু ঝা , শনিবারের বারবেলার একটু পরে ভর সন্ধ্যেয় খুন হয়ে গেল শক্তিগড়ের ল্যাংচা দোকানের সামনে ! হিন্দী বলয়ের রাজ্য টাজ্য গুলোয় এরকম হয় আকছার , তা নিয়ে নানান মুখরোচক ওয়েব সিরিজও হয়ে যাচ্ছে , গোগ্রাসে গিলছে মানুষ। কিন্তু এ বঙ্গ রাজ্যে এরকম শ্যুট আউট ? এ যেন নিখুঁত চিত্রনাট্য ! দুর্গাপুর থেকে রাজু ঝা কলকাতার দিকে যাচ্ছে , শক্তিগড়ে গাড়ীচালক ঝালমুড়ির জন্য দাঁড়াল। চালক নেমে ঝালমুড়ি কিনতে গেল । পেছন পেছন নীল রঙা গাড়ী( তাই তো বলছে প্রত্যক্ষদর্শীরা) ঝা বাবুর সাদা গাড়ীর পাশে দাঁড়ালো , তারপরের “আতশবাজি”। লুটিয়ে পড়লেন রাজু ঝা , পেছনে ছায়াসঙ্গী ব্রতিন মুখার্জী গাড়ীর ভেতর শুয়ে পড়লেন , তার হাতে গুলি লাগল ! আশেপাশের লোক ছুটে এল , ততক্ষনে নীল গাড়ী হাওয়া হয়ে গেল। এরকম চিত্রনাট্য লিখতে পারলে সেলিম-জাভেদও গর্বিত হতেন। যাইহোক , শ্যুট আউট পর্ব নির্বিঘ্নে মিটে গেল , কলাকুশলীরা জাস্ট উবে গেল। পড়ে রইলেন দুর্গাপুরের একসময়ের অবৈধ কয়লা কারবারের কিংপিন রাজু ওরফে রাজেশ ঝা , ততক্ষনে তার প্রানবায়ু পগার পার।

এই রাজু বাবু নাকি এখন আর কয়লা ব্যবসায়ী নন , তিনি নাকি হোটেল ব্যবসায়ী। হ্যাঁ,দুর্গাপুরে তিনি একটি তারা মার্কা হোটেল বানিয়েছেন বটে ! তবে এর সাথে আরও একটি পরিচয় ইতিমধ্যেই তিনি অর্জন করেছিলেন , তা হোল , তিনি বিজেপি নেতা। ২০২১ এর নির্বাচনের আগে তৎকালীন রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষের হাত ধরে বিজেপি তে যোগদান , পলাশ ডিহার ময়দানে। সেই ময়দানে দেখা গিয়েছিল একাধিক পোস্টার, ” আমরা রাজু দার অনুগামী”।

সময় গড়াতেই জানা গেল , যে গাড়ীতে রাজু বাবু ছিলেন , সেটি নাকি জনৈক আবদুল লতিফের। তা কে এই আবদুল লতিফ ? বীরভূমের তৃণমূল জেলা সভাপতি অনুব্রত মন্ডল ঘনিষ্ঠ , গরুপাচার কান্ডে যাকে হন্যে হয়ে খুঁজছে সিবিআই। এই গাড়ী , যার নম্বর ডব্লিউ বি ৪৮ ডি ৭০৩২ , সেটি ব্যবহার করতেন এই আবদুল লতিফ। এবং এদিন নাকি তিনিই তার দুবরাজপুর নিবাসী বিশ্বস্ত চালক দিয়ে গাড়ী পাঠিয়েছিলেন রাজু বাবুর জন্যে। এখানেই গভীর প্রশ্ন ? আবদুল লতিফ কেন গাড়ী পাঠাবেন রাজু ঝায়ের জন্য ? এই আবদুল লতিফ তো গরু পাচার,বালি পাচার সহ একাধিক বেআইনি লেনদেনের সাথে যুক্ত, এমনই অভিযোগ কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা সিবিআই এর। তাহলে লতিফের সাথে কি যোগসূত্র রাজু ঝা এর?

তৃণমূল জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল ঘনিষ্ঠ আব্দুল লতিফ গাড়ি পাঠাচ্ছে বিজেপিতে যোগদানকারী রাজু ঝায়ের জন্য ! অনুব্রতর ব্যক্তিগত দেহরক্ষী সাইগল হোসেনের আবিষ্কার এই আব্দুল লতিফ । অনুব্রত , সায়গল হোসেন দিল্লির তিহার জেলে। আব্দুল লতিফ ফেরার। তাহলে কি এদের বিপুল সম্পত্তি ও বেআইনি ব্যবসার দায়িত্ব নিয়েছিলেন রাজু ঝা? বাম আমল থেকেই অবৈধ কয়লার ব্যবসায় হাত পাকিয়েছিলেন রাজু ঝা। এক সময় কয়লার অবৈধ ব্যবসার কিং পিন ছিলেন এই রাজু। আসানসোল দুর্গাপুর রানিগঞ্জ অন্ডাল সহ একাধিক থানায় রাজু ঝায়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ লিপিবদ্ধ আছে। সিআইডি সহ বিভিন্ন থানার পুলিশের হাতে একাধিকবার গ্রেপ্তার হয়েছিলেন রাজু। ২০২০ সালের ডিসেম্বর মাসে তৎকালীন বিজেপি রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষের হাত ধরে ভারতীয় জনতা পার্টিতে পদার্পণ। প্রথম প্রথম কয়েক দিন দলীয় কর্মসূচিতে রাজুকে দেখা গেলেও পরবর্তীতে প্রকাশ্যে সেভাবে আর দেখা যায়নি। দুর্গাপুর পশ্চিমের বিজেপি বিধায়ক লক্ষণ ঘরুই বলেন যে উনি বিজেপিতে যোগ দিয়েছিলেন ঠিকই কিন্তু দলের সাথে তার কোন যোগাযোগ ছিল না।

মজার ব্যাপার হলো এই রাজু ঝা দুর্গাপুরের সিটি সেন্টারে একটি বিলাসবহুল তারা মার্কা হোটেল বানিয়েছেন। আরো মজার বিষয় হল এই হোটেলটি কার্যত বিজেপির নেতা-নেত্রীদের আস্তানা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সেক্ষেত্রে লক্ষণ বাবুর কথা অনুযায়ী রাজুর বিজেপি যোগ ছিল না, সেটা কি আদৌ ধোপে টেকে ?
কিন্তু প্রশ্নটা হল তৃণমূল জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলের ঘনিষ্ঠ আব্দুল লতিফ কেন গাড়ি পাঠালেন এবং সেই গাড়ি রাজুকে নিয়ে কোথায় যাচ্ছিল? বর্ধমানের পুলিশ সুপার কামনাশীষ সেন জানিয়েছেন সবদিক খতিয়ে পুলিশ তদন্ত করে দেখছে এবং আততায়ীরা শীঘ্রই ধরা পড়বে।
সিপিআইএম নেতা পঙ্কজ রায় সরকার এই হত্যাকাণ্ড প্রসঙ্গে বলেন,”দুই শাসক দলের মাফিয়াদের প্রশ্রয়। প্রান ওষ্ঠাগত সাধারনের।এরকম শুট আউট,গ্যাং ওয়ার সিনেমায় দেখেছি।দুর্গাপুর ক্রিমিনালদের সেফ স্টেবল”।
গত ২৬ শে ফেব্রুয়ারি ২০২৩, দুর্গাপুরের অম্বুজা কলোনিতে রাজু ঝা ঘনিষ্ঠ এক ব্যবসায়ীর কার্যালয়ে তার ভাইকে গুলি করে দুষ্কৃতীরা। অল্পের জন্য প্রাণে বাঁচে ওই ব্যক্তি। সেই ঘটনার সাথে এর কোন যোগসূত্র আছে কিনা, সেটাও তদন্ত সাপেক্ষ। তবে সেই ঘটনায় কোন গ্রেপ্তারি নেই।
এক নিখুঁত পরিকল্পনা করে শুট আউট, একসময়ের কুখ্যাত কয়লা কারবারির শরীরে ঢুকিয়ে দিল গরম সীসা, অত্যন্ত পেশাদারিত্ব না থাকলে এভাবে হয় না বলেই পুলিশের একাংশের অভিমত। তবে যা ঘটলো তা শিল্পাঞ্চলকে তোলপাড় করার জন্য যথেষ্ট। তাহলে কি এর নেপথ্যে ব্যবসায়িক শত্রুতা? কালো হীরের বিপুল সাম্রাজ্যের অবৈধ লেনদেন হস্তান্তর ? বীরভূম যোগ ? আগামী কয়েক দিন এই ইস্যুতেই শিল্পাঞ্চল সরগরম থাকবে ।
শেষ পাওয়া খবর অনুযায়ী শক্তিগড়ের কাছে একটি নীল রঙের বেলেনো গাড়ি পরিত্যক্ত অবস্থায় উদ্ধার করেছে পুলিশ। যে গাড়ির ভেতরে বেশ কয়েকটি নম্বর প্লেট পাওয়া গেছে। এই নীল গাড়িতেই কি রচিত হয়েছিল অবৈধ কয়লা ব্যবসার কিং পিন রাজু ঝায়ের খুনের নীল নকশা ?